কামিনী ও স্বর্ণলতা | হেনা সুলতানা


 

যখনকার কথা বলছি তখন সে যুবতী নয়। তবে বৃদ্ধও নয়। তার যাত্রা ভাটির দিকে। বয়সের থেকেও বেশী শক্ত দেখায়। কৈশোর আর যৌবনের জাল ছিঁড়ে ফুঁড়ে চলা জীবন। ফুল ফোটায় আকাশ আলো করে। তবু কন্ঠে গান উঠে লতিয়ে। একই বৃন্তে থোকা থোকা ফুল গন্ধে , বর্ণে, রূপে, রসে ফোটে শুভ্রতা নিয়ে একসাথে। ঝরবেও একসাথে পাপড়ি খুলে খুলে। ফুলের পরমায়ু, উদ্দেশ্য, জীবন সবটুকু মিশে যায় বাতাসে।

এই পরমায়ু, এই পরিতাপ, এই দীর্ঘশ্বাস হারিয়ে যেতে না যেতে আবার ফুটে ওঠার আয়োজন! জন্ম সুখ!! জীবন শুধু ফুরিয়ে যাওয়া পরমায়ু নয়!!!

পৃথিবীতে যাদের জীবনে প্রেম, ভালবাসা স্নেহ ছাড়া কিছু চাইবার নেই - পৃথিবীর এতো জটিলতা, এতো হিংসা, এতো মিথ্যা, নিষ্ঠুরতা, অসুন্দর, এতো জাত ভেদ দেখে দেখে সে কষ্ট পায়। সে নির্বোধ নয়, তবে সরল। ফলে অন্যের প্রতারণার বিষ খেয়ে হয় নীল কন্ঠ। নিষ্পাপ, কখনো তার সাফল্যের সঙ্গে মিশে সৃষ্টি করে দঃখ। তবু বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকে।

সে জীবন কামিনীর।

সারারাত ছিল দুধে আলতা লাগানো পূর্ণিমা চাঁদ।

সেদিনও আষাঢ়ি পূর্ণিমা।

কামিনীর ঘুম ভাঙ্গে সেই ভোরবেলায় যখন অন্যদের ঘুম থেকে ওঠার আড়মোড়া ভাঙ্গেনি।

ভোরের পাখিরা তখনও ভোর জাগায়নি। সেই ভোরে কামিনীর ঘুম ভাঙ্গে যে ভোর এতোটাই আঁধার যে মৃতদেহ চিতায় ওঠানোর আগেও তারা একটু অপেক্ষা করে কিছু আলোর জন্যে।

সেই ভোর। কামিনীর ঘুম ভাঙ্গে কারো রোদন ভরা বিলাপে।

সারারাত ফুল ফুটিয়ে সে ক্লান্ত। কিন্তু রোদন তো সে আর সইতে পারে না।

আশপাশ চোখ খুঁজে ফেরে। বিলাপের উৎস কামিনীর গোড়াতেই।

একটুকরো লতা। অনাথ পড়ে আছে।

দুষ্টু ছেলেরা কাল লাটাইয়ের সুতো থেকে ছুটে যাওয়া ঘুড়ি খুঁজে পেতে বাগান তছনছ করে ফেলেছে। তাদের দস্যুতায় এই তান্ডব ঘটে গেছে।

গাছের ডালপালা, লতাপাতা তাদের নিষ্ঠুর হাতে ছিঁড়েখঁড়ে ফেলে গেছে।

আহা ছোট্ট একটুকরো স্বর্ণলতা কাঁদছে বড় যন্ত্রণায়।

একটু আশ্রয় চাই! একটু আশ্রয় দাও!!

কামিনী স্বর্ণলতাকে টেনে নিল কাছে, একেবারে বুকের ভিতর।

কি ভালই না বাসলো তাকে।

স্বর্ণলতা! আশ্রয় পেয়ে কামিনীর ঝোপের ছায়ায় ধীরে ধীরে এডাল থেকে ওডাল, ওডাল থেকে সে ডাল - তার অবাধ গতি।

বিশাল ফুলধরা গাছটিকে সে আষ্টেপৃষ্টে  জড়িয়ে ফেলে

-তো জড়িয়ে থাকা নয় -যে গ্রাস করা

তার ডালে ডালে নেই শুভ্র সুবাসভরা ফুল

তার কাছে কোন মৌমাছি আসে না, রঙিন প্রজাপতি নয়। বুলবুলি, চড়াই, টুনটুনি কেউ নয়

তাকে আজ চেনাই য়ায় না।  তার সবটুকু গ্রাস করেছে

সুযোগ পেলেই  সে অন্য গাছের   বুকে চড়ে চামর দোলায় পরজীবী পত্রহীন স্বর্ণলতা নাকি আলক লতা? সে একাই। দুটো নামই তার!!!


0 মন্তব্যসমূহ